আলোর উৎসব ও আনন্দের মহোৎসব দীপাবলি
দীপাবলি, বাংলায় 'আলোয় ভরা উৎসব' নামে পরিচিত, ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বর্ণময় উৎসবগুলোর একটি। এটি মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হলেও, ভারত, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। দীপাবলি বা দীপোৎসবকে আলোর উৎসব বলা হয়, যেখানে আলো, আনন্দ, এবং শুভ্রতার বিজয় উদযাপন করা হয়। এ উৎসবের সময় চারিদিক মোমবাতি, প্রদীপ এবং আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়, যা অন্ধকার দূর করে চারপাশকে আলোকিত করে তোলে।
দীপাবলির উৎপত্তি ও ইতিহাস
দীপাবলি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ 'দীপাবলী' থেকে, যার অর্থ 'আলোর সারি'। ভারতের মহাকাব্য রামায়ণ অনুযায়ী, চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে ভগবান রামচন্দ্র, তাঁর পত্নী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁদের আগমনের আনন্দে অযোধ্যাবাসীরা ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে তাঁদের বরণ করে নেন। এই সময় থেকেই দীপাবলি উৎসবের প্রচলন শুরু হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে এটি ভিন্ন ভিন্ন দেবতা ও ধর্মীয় কাহিনির সাথে যুক্ত হয়ে উদযাপিত হয়। যেমন, কালীপূজার দিনও দীপাবলি পালন করা হয়, যেখানে দেবী কালীকে অশুভ শক্তির বিনাশের প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়।
দীপাবলির উদযাপন: দিনগুলোর বিবরণ
দীপাবলি মূলত পাঁচ দিন ধরে পালিত হয় এবং প্রতিটি দিনের নিজস্ব একটি তাৎপর্য রয়েছে। এই পাঁচটি দিন হলো: ধনতেরাস, নারক চতুর্দশী, লক্ষ্মী পূজা, গোবর্ধন পূজা এবং ভাই দুজ।
ধনতেরাস: দীপাবলির প্রথম দিন ধনতেরাস নামে পরিচিত। এদিন ধন দেবতা কুবের এবং স্বাস্থ্য দেবতা ধন্বন্তরীকে পূজা করা হয়। ধন ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে মানুষ সোনাদানা, গৃহের আসবাবপত্র বা অন্য কোন মূল্যবান জিনিস কেনে।
নারক চতুর্দশী (ছোট দীপাবলি): দীপাবলির দ্বিতীয় দিনটিকে নারক চতুর্দশী বা ছোট দীপাবলি বলা হয়। এই দিনটিতে ভগবান কৃষ্ণ নারকাসুর নামক এক অসুরকে বধ করেছিলেন। এটি দুষ্টের বিরুদ্ধে শুভ্রতার বিজয় হিসেবে স্মরণ করা হয়। এদিনটি আগের দিনের চাইতে বেশি আলোকিত করা হয়।
লক্ষ্মী পূজা: দীপাবলির তৃতীয় দিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেদিন মা লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। অর্থ, সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীকে ঘরে ঘরে পূজা করা হয়। এদিন সন্ধ্যায় বাড়ির প্রবেশপথ ও জানালাগুলো প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়, যাতে দেবী লক্ষ্মী প্রবেশ করে গৃহে সমৃদ্ধি নিয়ে আসেন।
গোবর্ধন পূজা: চতুর্থ দিনটিতে গোবর্ধন পূজা পালন করা হয়। এই দিনটিতে গোবর্ধন পর্বত পূজিত হয়। কৃষ্ণ বিশ্বাস অনুযায়ী, কৃষকরা তাঁদের জীবিকা এবং পণ্য উৎপাদনের জন্য কৃষি ও প্রাণিসম্পদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে।
ভাই দুজ: দীপাবলির পঞ্চম এবং শেষ দিনটি ভাই দুজ নামে পরিচিত। এই দিনটি ভাই ও বোনের মধ্যে বন্ধনের প্রতীক হিসেবে পালন করা হয়। বোনেরা ভাইদের দীর্ঘায়ু এবং সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা করে এবং ভাইয়েরাও তাঁদের সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করার অঙ্গীকার করে।
দীপাবলির আয়োজন এবং আলোকসজ্জা
দীপাবলির সময় চারদিকে আলোকসজ্জার এক অসাধারণ সৌন্দর্য দেখা যায়। মাটির প্রদীপ, মোমবাতি, বৈদ্যুতিক বাতি এবং অন্যান্য আলো দিয়ে ঘরবাড়ি সজ্জিত করা হয়। প্রতিটি বাড়ি একটি প্রদীপ বা আলো দিয়ে আলোকিত হয়, যাতে করে অশুভ শক্তির প্রতীক অন্ধকার দূর হয়ে যায়। বিশেষত সন্ধ্যা নামার পর দীপাবলির আলোয় চারদিকের প্রকৃতি এক অনন্য রূপ ধারণ করে।
দীপাবলির সঙ্গে কালীপূজার সম্পর্ক
বাংলায় দীপাবলির দিনেই কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এটি মূলত পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, উড়িষ্যা, আসামসহ বিভিন্ন বাংলাভাষী অঞ্চলে পালিত হয়। দেবী কালীকে শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। কালীপূজা হলো অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক। দীপাবলির দিন, কালীপূজার মাধ্যমে বাংলার মানুষ শক্তির আরাধনা করে এবং দেবী কালীর কাছে সব অমঙ্গল থেকে সুরক্ষার প্রার্থনা করে।
খাদ্য, মিষ্টান্ন এবং উপহার বিনিময়
দীপাবলির আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো মিষ্টান্ন ও উপহার বিনিময়। এই উৎসবে লাড্ডু, বারফি, পেঁড়া, গুজিয়া, শাঁকরপালীসহ নানা রকম মিষ্টির প্রচলন রয়েছে। একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানো হয় এবং মিষ্টির ডালি উপহার দেওয়া হয়। দীপাবলির শুভেচ্ছা জানানোর জন্য পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে নানা রকম খাবার এবং উপহারের আদানপ্রদান করে।
আধুনিক যুগে দীপাবলির উদযাপন
বর্তমানে দীপাবলি শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি একটি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আধুনিক যুগে দীপাবলির উদযাপনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বৈদ্যুতিক আলো, বাজির প্রভাব এবং বিভিন্ন আধুনিক উদ্ভাবন যুক্ত হয়েছে। যদিও অনেক জায়গায় বাজির ব্যবহার ধীরে ধীরে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, কারণ এটি পরিবেশের ক্ষতি করে।
দীপাবলির পরিবেশগত প্রভাব ও সতর্কতা
দীপাবলির সময় অধিক পরিমাণে বাজি ফাটানোর ফলে বায়ু দূষণ বেড়ে যায়। এতে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দীপাবলি উদযাপন করতে গিয়ে যেন পরিবেশ দূষণ না ঘটে, সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। তাই অনেক মানুষ এখন পরিবেশবান্ধব উপায়ে, যেমন মাটির প্রদীপ এবং পরিবেশবান্ধব উপাদান ব্যবহার করে দীপাবলি উদযাপন করছেন।
উপসংহার
দীপাবলি একটি সর্বজনীন উৎসব যা মানুষের জীবনে আলো ও আনন্দ নিয়ে আসে। এটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য এবং বন্ধনের প্রতীক। এ আলোর উৎসবের মাধ্যমে সকল অন্ধকার দূর হয়ে পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠুক, এই শুভকামনাই দীপাবলির অন্যতম বার্তা।